আজ শনিবার, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘মায়ের ডাক’ ভ্যানগাড়ি এক বছরেই অচল

নিজস্ব প্রতিবেদক:

গর্ভবতি মায়েদের সেবায় এ্যাম্বুলেন্স বা ইঞ্জিন চালিত গাড়ি নয় ; দেয়া হয়েছে প্যাডেল চালিত ভ্যান! তাও আবার চালক বিহীন! লাখ টাকা প্রকল্পের ওই খোলা ভ্যানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মায়ের ডাক’। বছর খানিক আগে আগে প্রভাবশালী এক সাংসদ ও তার গৃহীনিকে অতিথি করে তা উদ্বোধনও করেছে একাধিকবার। কার্যত ‘দূর্ভাগা’ সাত ভ্যানের কোনটাই শেষ পর্যন্ত রোগির দেখা পায়নি!

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বদলে যাওয়া এই জনপদের পিচঢালা সড়কে পায়ে চালিত এই ভ্যানের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা নিয়ে উঠেছে শত প্রশ্ন। ‘অতি মানবিকতার’ দেয়াল হয়তো সেই প্রশ্ন আড়াল করেছিলো সাবেক ইউএনও নাহিদা বারিকের চেতনায়। মানবিকতার উদাহরণ টানতে গিয়ে উল্টো সমালোচনাই চলছে নাহিদা বারিকের ‘মায়ের ডাক’ নামক ‘মানবিক’ ভ্যান নিয়ে।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক ইউএনও ছিলেন নাহিদা বারিক। বিদায়ের শেষ বেলায় এসে তিনি সদর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে সাতটি ভ্যান দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের দেয়া এক বরাদ্দ থেকে। গর্ভবতি মায়েদের হাসপাতাল যাতায়াতের জন্য প্যাডেল চালিত সাতটি ভ্যান সাতটি ইউনিয়নে দেয়া হলেও বর্তমানে তা পুরোপুরি অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে বিভিন্ন স্থানে। ময়লা ও মরিচায় পরিত্যাক্ত রূপ নিয়েছে লাখ টাকার এই প্রকল্প। আবার কোনটা গ্রহণই করেননি ইউনিয়ন পরিষদের কোন কোন চেয়ারম্যান।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্যাডেল চালিত ওই সাত ভ্যানের প্রস্তাবকারী ছিলেন সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার প্রদীপ চন্দ্র রায়। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী সাত ইউনিয়নে সাতটি ভ্যানগাড়ি দেয়ার প্রকল্প অনুমোদন দেন তৎকালিন ইউএনও নাহিদা বারিক। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এলজিএসপি-৩ এর আওতায় ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ‘মায়ের ডাক’ নামক ওই ভ্যানগাড়ির প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। সাবেক ইউএনও নাহিদা বারিকের নির্দেশে ১ লাখ টাকার ওই প্রকল্পের কাজ ৯৪ হাজার টাকায় সম্পন্ন করেন ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফুর রহমান স্বপন।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তা আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করেন সাংসদ শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান লিপি। একই প্রকল্পের ভ্যান দ্বিতীয়বার উদ্বোধন করেন স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানও। উপজেলা পরিষদের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভাগীয় কমিশনার উপজেলায় আসার পর ওই ভ্যান দেখিয়ে বাহবা কুড়িয়েছিলেন ইউএনও নাহিদা বারিক।

চেয়ারম্যানরা বলছেন, মানবিক এবং মহৎ উদ্দেশ্যের হলেও সস্তার এই ভ্যান প্রকল্প কাজে আসেনি। খোদ প্রকল্প প্রস্তাবকারী প্রদীপ চন্দ্র সাহা বর্তমান আধুনিক প্রেক্ষাপটে এই ‘অতি মানবিক’ প্যাডেল ভ্যানের প্রকল্প এক কথায় ‘অহেতুক’। প্রকল্প প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রদীপ চন্দ্র সাহা বলেন, আমি প্রকল্প প্রস্তাব করেছিলাম। আসলে বাজেট তত বেশি না থাকায় ভ্যান দেয়া হয়েছে। এর সাথে চালক, তোষক, বালিশ, কোম্বলসহ আরো আনুসাঙ্গিক কিছু বিষয় আছে, যেগুলো করা হয়নি। ফলে পুরো বিষয়টি অসম্পূর্ন থেকে গেছে। এই বিষয়ে বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করবো।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শহরে প্যাডেল ভ্যানের কদর নেই তবে এমনও মানুষ রয়েছে যাদের পক্ষে ২০০ টাকা গাড়ি ভাড়া দেয়াটা কষ্টকর। তাদের কথা চিন্তা করে প্রস্তাব করা হয়েছিল। আসলে নোয়াখালিতে দেখেছি যে, বড় টেম্পুকে মডিফাই করে এমন গাড়ি বানানো হয়েছিল রোগিদের জন্য। শহর এলাকা হিসেবে তেমন কিছু করা যেতে পারে।

জানতে চাইলে ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফুর রহমান স্বপন বলেন, ‘সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাহিদা বারিক ম্যাডাম প্রতিটি ইউনিয়নে অসহায়দের জন্য ওই ভ্যান দিয়েছে। যাতে বিনা ভাড়ায় হাসপাতালে যাওয়া যায়। বিশ্বব্যাংক এবং এলজিএসপি’র অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। ১ লাখ টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হলেও ১৪ হাজার টাকা করে ৭টি ভ্যানে ৯৪ হাজার টাকা ব্যায় হয়। ভ্যানের উদ্দেশ্য মহৎ থাকলেও উন্নয়নশীল এলাকায় তা কাজে আসেনি। কারণ একজন গর্ভবতি নারীকে তার স্বজনরা এই প্যাডেল চালিত ভ্যানে উঠাবেন না। এখনো পর্যন্ত একজন রোগীও ভ্যানে উঠেনি। তার আগেই ভ্যানে মরিচা ধরে গেছে। তাছাড়া, ভ্যান থাকলেও চালক নেই, নানা অসঙ্গতি রয়েছে।’

বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম শওকত আলী বলেন, ‘উদ্দেশ্যটা নিঃসন্দেহে মহৎ। কিন্তু যেই যুগে ইঞ্জিন চালিত গাড়ির অবাধ চলাচল, সেই যুগে প্যাডেল চালিত ভ্যানের কদর থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ এখন অটোরিক্সা-সিএনজিতে চালাচল করে। প্রয়োজনে এ্যাম্বুলেন্স নেয়। এখানে পায়ে চালিত ভ্যানে কে উঠবে। আমার ইউনিয়নের ভ্যান নেইনি।’

এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এই ভ্যানগুলো গ্রামে চলে, শহর এলাকায় নয়। শহর এলাকায় একটি গরিব রোগিকেও ভ্যানে বসাতে পারবেন না। তারপরও ভ্যানের বিষয়ে এলাকাবাসীকে অবগত করেছি কিন্তু কোনো রোগি ভ্যানের জন্য আসেনি। তাই ভ্যান চালকও রাখিনি। এটা এভাবেই পড়ে আছে। এগুলো আমাদের এলাকার জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানে ইঞ্জিন চালিত ভালো কোন গাড়ির ব্যবস্থা করা গেলে কাজে আসতো।’

কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম সাইফউল্লাহ বাদল বলেন, আমার ইউনিয়নে ওই ভ্যান আসেনি।’

কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু বলেন, ‘ভ্যানগাড়ির বিষয়ে শুনেছি কিন্তু তা ইউনিয়ন স্বাস্থকেন্দ্রে নেয়া হয়েছে কিনা জানা নেই। তাছাড়া, এই সময়ে এসে পায়ে চালিত ভ্যান গর্ভবতি রোগিদের যাতায়াতে খুব একটা কাজে আসবে না। সড়ক, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। সেখানে এ্যাম্বুলেন্স দিতে না পারলেও ইঞ্জিন চালিত গাড়ি ব্যবস্থা করা যেত। ভ্যানের কারণে পুরো উদ্যোগ অসম্পূর্ন হয়েছে। ভ্যান দিলো, চালক দিবে কে? পারিশ্রমিকেরও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।’